শ্রীমদ্ভগবদগীতা - অধ্যায় ৭, শ্লোক ৪
শ্লোক
**ভূমির্আপো'নলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।**
**অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।৭।৪।।**
শব্দার্থ
**ভূমিঃ** - মাটি, পৃথিবী; **আপঃ** - জল; **অনলঃ** - অগ্নি; **বায়ুঃ** - বায়ু; **খম্** - আকাশ; **মনঃ** - মন; **বুদ্ধিঃ** - বুদ্ধি; **এব** - নিশ্চয়ই; **চ** - এবং; **অহঙ্কারঃ** - অহঙ্কার; **ইতি** - এইভাবে; **ইয়ম্** - এই সমস্ত; **মে** - আমার; **ভিন্না** - বিভক্ত, পৃথক; **প্রকৃতিঃ** - ভৌতিক প্রকৃতি, শক্তি; **অষ্টধা** - আটভাগে।
অনুবাদ
পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার - এই আটটি তত্ত্ব আমার ভিন্না প্রকৃতি।
তাৎপর্য
এই শ্লোকটিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি অত্যন্ত মৌলিক সত্য উন্মোচন করেছেন। তিনি বলছেন যে, এই দৃশ্যমান জগতের সমস্ত উপাদান - স্থূল থেকে সূক্ষ্ম পর্যন্ত - তাঁরই শক্তির প্রকাশ। কিন্তু এখানে "ভিন্না প্রকৃতি" শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ হলো - এই সব উপাদান তাঁর শক্তি হলেও, তিনি এদের থেকে পৃথক এবং উর্ধ্বে। ঠিক যেমন সূর্য থেকে আলো ও তাপ নিঃসৃত হয়, কিন্তু সূর্য নিজে আলো বা তাপে পরিণত হয় না। বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ভগবানের স্বরূপ এবং তাঁর বিভিন্ন শক্তিকে বোঝাই হলো সত্যিকারের বিজ্ঞান। আধুনিক বিজ্ঞান শুধুমাত্র জড় পদার্থের বাহ্যিক রূপ নিয়ে গবেষণা করে, কিন্তু এর মূল উৎস সম্পর্কে অন্ধকারে থাকে। ভগবত্তত্ত্ব বিজ্ঞান আমাদের শেখায় যে, এই জড় জগতের পেছনে রয়েছে একটি চেতন শক্তি, যা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সাত্বত-তন্ত্রে বর্ণিত আছে যে, জড় সৃষ্টির জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তিনটি বিষ্ণু-রূপে প্রকাশিত হন -
১. মহাবিষ্ণু (কারণোদকশায়ী বিষ্ণু): তিনি মহত্তত্ত্ব সৃষ্টি করেন। এটি হলো জড় শক্তির প্রাথমিক উৎস। তাঁর নিশ্বাসে অগণিত ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয় এবং প্রশ্বাসে লয় পায়। এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া - কল্পের পর কল্প ধরে এই সৃষ্টি ও ধ্বংস চলতে থাকে।
২. গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু: তিনি প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে বিভিন্ন গ্রহলোক, নক্ষত্রমণ্ডল এবং জীবজগতের সৃষ্টি করেন। প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডে একজন ব্রহ্মা, একজন বিষ্ণু এবং একজন শিব নিযুক্ত হন সৃষ্টি, পালন ও সংহারের জন্য।
৩. ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু (পরমাত্মা): তিনি সর্বব্যাপী - প্রতিটি জীবের হৃদয়ে, প্রতিটি পরমাণুর মধ্যে, এমনকি প্রতিটি চিন্তার মধ্যেও তিনি উপস্থিত। তিনিই হলেন পরমাত্মা, যিনি সব কিছুর সাক্ষী এবং অন্তর্যামী।
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমরা মনে করি যে এই জড় জগৎ আমাদের ভোগের জন্য তৈরি এবং আমরাই এর নিয়ন্তা। এই ভ্রান্তি থেকেই জন্ম নেয় সব ধরনের সংঘাত, দুঃখ এবং বন্ধন। প্রকৃতপক্ষে, আমরা এই জড় প্রকৃতির দাস, মালিক নয়। ঠিক যেমন একজন বন্দী কারাগারের নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য, তেমনি আমরাও জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধির নিয়মের অধীন। প্রথম পাঁচটি তত্ত্ব - পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ - এগুলো হলো স্থূল উপাদান। এই পঞ্চমহাভূত দিয়েই গঠিত আমাদের স্থূল শরীর এবং চারপাশের জগৎ। প্রতিটি উপাদানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে -
পৃথিবী :- কঠিনতা, স্থিতিশীলতা ও গন্ধের আধার
জল :- তরলতা, শীতলতা ও রসের আধার
অগ্নি :- তেজ, উষ্ণতা ও রূপের আধার
বায়ু :- গতি, স্পর্শের আধার
আকাশ :- শূন্যতা, শব্দের আধার
কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান শুধুমাত্র এই স্থূল উপাদানগুলোর রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তারা এর পেছনের চেতন নিয়ন্তাকে স্বীকার করতে চায় না। মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার - এই তিনটি সূক্ষ্ম তত্ত্বকে আধুনিক জড়বাদী দর্শন সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। তারা এগুলোকে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ক্রিয়া মনে করে। কিন্তু বৈদিক জ্ঞান অনুযায়ী -
মন : এটি হলো চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছার কেন্দ্র। মন দিয়েই আমরা বাহ্য জগতের সাথে যোগাযোগ করি। মন যদি শুদ্ধ হয়, তাহলে আমাদের উপলব্ধিও শুদ্ধ হয়। আর মন যদি কলুষিত হয়, তাহলে সবকিছুকেই বিকৃত দেখায়।
বুদ্ধি : এটি হলো বিচার-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি। বুদ্ধিই ঠিক-ভুলের পার্থক্য করে। কিন্তু যদি বুদ্ধি কৃষ্ণভাবনায় অর্পিত না হয়, তাহলে তা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
অহঙ্কার : এটিই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। "আমি দেহ", "আমি কর্তা", "আমি ভোক্তা" - এই মিথ্যা পরিচিতিই আমাদের বন্ধনের মূল কারণ। প্রকৃতপক্ষে, আমরা আত্মা - শাশ্বত, জ্ঞানময় ও আনন্দময়।
এই আট প্রকার মৌলিক তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয় আরও ষোল প্রকার তত্ত্ব - মোট চব্বিশটি। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক), পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় (হাত, পা, বাক্, গুহ্য, উপস্থ), পাঁচ ইন্দ্রিয়বিষয় (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) এবং একটি অব্যক্ত তত্ত্ব। নিরীশ্বরবাদী সাংখ্য দর্শন এই চব্বিশ তত্ত্ব নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে, কিন্তু তাদের মূল ভুল হলো - তারা এই সবকিছুর পরম উৎস ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্বীকার করে না। তারা মনে করে প্রকৃতি এবং পুরুষ (জীব) স্বাধীন সত্তা। কিন্তু গীতা পরিষ্কার করে বলে যে, প্রকৃতি এবং জীব - উভয়েই ভগবানের অধীন।এমনকি নির্বিশেষবাদীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ব্রহ্মজ্যোতিও ভগবানের একটি শক্তি মাত্র। ব্রহ্মজ্যোতি হলো ভগবানের দেহ থেকে নিঃসৃত আলো, যা বৈকুণ্ঠলোকসমূহকে ঘিরে থাকে। কিন্তু ব্রহ্মজ্যোতিতে কোনো ব্যক্তিত্ব নেই, কোনো লীলা নেই, কোনো রস নেই - শুধু আলোর সমুদ্র অনুরূপভাবে, পরমাত্মাও ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর একটি প্রকাশ। চিন্ময় জগতে পরমাত্মার এই রূপের প্রয়োজন নেই, কারণ সেখানে সব জীব স্বাভাবিকভাবেই ভগবানের সাথে প্রেমময় সম্পর্কে আবদ্ধ। সুতরাং, যথার্থ পরম তত্ত্ব হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনিই পূর্ণ শক্তিমান। তাঁর রয়েছে তিন প্রকার শক্তি -
১. অন্তরঙ্গা শক্তি (স্বরূপ শক্তি) : চিন্ময় জগত, ভগবানের নিত্যপার্ষদরা
২. তটস্থা শক্তি (জীবশক্তি) : আমরা জীবাত্মারা
৩. বহিরঙ্গা শক্তি (মায়া শক্তি) : এই জড় জগৎ
আজকের বিজ্ঞান শুধুমাত্র বহিরঙ্গা শক্তির একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়েই গবেষণা করে। তারা মনে করে যে, জৈবিক বিবর্তনের মাধ্যমে চেতনা এসেছে। কিন্তু বৈদিক জ্ঞান বলে, চেতনাই প্রথম - তার থেকেই জড় উপাদান সংগঠিত হয়। একটি মৃত দেহে সব উপাদান থাকে, কিন্তু চেতনা না থাকায় তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এই অষ্টধা প্রকৃতি আসলে মায়াশক্তির প্রকাশ। মায়া মানে "যা নেই"। এই জড় জগৎ সত্য নয় - অর্থাৎ এটি চিরস্থায়ী নয়। এটি ভগবানের স্বপ্নের মতো। আমরা এই স্বপ্নে জড়িয়ে পড়ে ভুলে যাই যে আমরা কে।জীবাত্মা প্রকৃতপক্ষে ভগবানের অংশ, কিন্তু মায়ার প্রভাবে সে নিজেকে এই জড় শরীরের সাথে একাত্ম মনে করে। এই মিথ্যা পরিচিতি থেকেই জন্ম নেয় সব ধরনের ভোগ ও লালসা। এই জড় বন্ধন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো কৃষ্ণভাবনা। যখন আমরা বুঝতে পারি যে -
- এই জগতের সবকিছুই ভগবানের শক্তি
- আমরা তাঁর অংশ, কিন্তু অন্য কিছুর মালিক নই
- আমাদের কাজ হলো তাঁর সেবা করা, ভোগ করা নয়
তখনই আমাদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হয়।
এই জ্ঞান আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে কাজে লাগানো যাই?
খাবারের ক্ষেত্রে : আমরা জানি যে এই খাবার ভগবানের শক্তি থেকে এসেছে। তাই প্রথমে তাঁকে নিবেদন করে তারপর গ্রহণ করা উচিৎ।
কাজের ক্ষেত্রে : আমাদের সব কাজ ভগবানের সেবার জন্য। আমাদের ফলের আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে দিয়ে কর্তব্য সম্পাদন করা উচিৎ।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে : সবাইকে ভগবানের অংশ হিসেবে দেখা। কারো সাথে হিংসা বা বিদ্বেষ না করা।
সমস্যার ক্ষেত্রে : বুঝি যে এই সব সমস্যা আমাদের কর্মের ফল। ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করে ধৈর্য ধরা।
এই অষ্ট প্রকৃতির রহস্য বুঝে যিনি ভগবানের শরণাগত হন, তিনিই জড় বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু শুধু বুদ্ধিগত জানাই যথেষ্ট নয় - প্রয়োজন হৃদয়ের অনুভূতি ও ভক্তি। এই শ্লোকটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা এই বিশাল সৃষ্টিরহস্যের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কিন্তু আমরা যদি ভগবানের সাথে আমাদের সম্পর্ক বুঝতে পারি, তাহলে এই ক্ষুদ্রত্বেও আমরা অসীম আনন্দ খুঁজে পেতে পারি।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
Comments
Post a Comment